ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ১৯৯৮ সালে ব্যাংকে চাকরি নেন তিনি। আওয়ামী লীগের একাধিক শাখা সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন। দলটির প্রকৌশলীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের ২০২৩ সালের কমিটিতে সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলনে বাড্ডা থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে এজাহারভুক্ত আসামিও তিনি। সেই কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম এখন রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। প্রায় দুই হাজার মানুষের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারের সময়ে গত বছর ২৪ ডিসেম্বর এই পদে নিয়োগ পান তিনি।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যাচেষ্টাসহ কয়েকটি অভিযোগে একটি মামলা হয়। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং-২১ এর আদেশ মূলে গত ৩ মার্চ মামলাটি বাড্ডা থানায় নিয়মিত মামলা (এফআইআর) হিসেবে নথিভুক্ত হয়। মামলা নম্বর-৬। মামলাটি দণ্ডবিধির ১৪৭/১৪৮/৩২৬/৩০৭/৫০৬/৩৪ ধারায় দায়ের হয়। যার মধ্যে হত্যাচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। মামলার ১ নম্বর আসামি পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মামলার ৪৫ নম্বরে রয়েছে কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলামের নাম। মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, এমন একটি মামলা রজু হয়েছে। তবে তদন্ত কাজ এখনো শুরু হয়নি। ওয়াহিদুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসাবে চাকরি জীবন শুরু করেন। গত দেড় দশকে প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে তিনি বড় বড় পদ বাগিয়ে নেন। তবে এতদিন এমডি হতে পারেননি। এবার আওয়ামী লীগ পতনের পর রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকের সর্বোচ্চ এমডি পদে আসীন হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় ক্যারিয়ার পাকাপোক্ত করতে সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ছায়াতলে থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে কাজী ওয়াহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে আগের রূপ পরিবর্তন করেন ওয়াহিদুল ইসলাম। রাতারাতি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি থেকে বনে গেছেন পরিবর্তিত সরকারের প্রশাসনেরও ঘনিষ্ঠজন। তিনি আরও বলেন, আমাদের স্যার ভীষণ চতুর। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে ক্ষমতার চর্চা করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও তিনি কোনো ঝামেলায় পড়েননি। বরং শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিতে পেরেছেন। রাজনৈতিক কারণেই আলোচনা-সমালোচিত নয়, ব্যাংকার হিসেবেও তার বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। রূপালী ব্যাংকেও রয়েছে বদলী, পদোন্নতি, ঋণ বিতরণসহ বিভিন্ন কাজে বিতর্ক। জানা গেছে, অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতাকে বড় বড় অংকের ঋণ দিয়েছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ ব্যাংক কর্মকর্তা ব্যাংকের কিছু অনিয়মের কথাও তুলে ধরেন। তিনি এমডি হয়ে আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করছেন বলেও অভিযোগ করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিলো ব্যাংকার্স রিক্রুটম্যন্ট কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নেতাদের চাকরি দেয়ার জন্য রূপালী ব্যাংক তাদের নিজেদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া শুরু করে। যেখানে ২০১০ সালে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যারা যোগদান করেন, তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক নিয়োগ। কিন্তু সর্বশেষ সুপারনিউমারি নামক ঢালাও পদোন্নতিতে তাদেরকেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত হিসাবে দেখিয়ে এমডি পদোন্নতি দেন। ২০১৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসারদের পদোন্নতিতেও হয়েছে ব্যাপক হারে অনিয়ম। যেখানে মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী যাদেরকে মেধাভিত্তিক পদোন্নতি দেয়ার কথা, তাদের মধ্যে যাদের সর্বশেষ পদোন্নতির ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, আর্থিক লেনদেন করে তাদেরকে সুপারনিউমারিতে পদোন্নতি দেন তিনি। ২০২০ এ নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার ব্যাচের কয়েকজনকে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা-১ পার্ট উত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও কোনো নিয়ম না মেনেই পদোন্নতি দেয়া হয় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি বিষয়ক এইসব অনিয়ম নিয়ে পদোন্নতি বঞ্চিতরা যখন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চায়, তখন সেসব কর্মকর্তাদেরকে গণহারে বদলী করা শুরু করেন এমডি ওয়াহিদুল ইসলাম। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ব্যাংক হিসেবে রূপালী ব্যাংকের অবস্থা যখন একদম নড়বড়ে তখন বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এইসবের ওপর কর্ণপাত না করে কর্মকর্তাদের বিপক্ষে অ্যাকশনে গিয়ে নিজেদের স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে, রূপালী ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল মাত্র ১০৩.৩১ কোটি টাকা (যেখানে থাকার কথা ২৪০০ কোটি টাকা) এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০% এর মত। যেখানে অনেক ঋণ বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাখার দায়িত্ব পালন করার সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ঋণ পাইয়ে দেন। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করলেও এ ব্যাংক কর্মকর্তা কার ইশারায় বহাল তবিয়তে আছেন? শুধু বহাল তবিয়তে থাকাই নয়, শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিতেও সক্ষম হয়েছেন! স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও সেই আমলে এমডি হতে পারেননি। আর এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঠিকই পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। এ ব্যক্তি ক্ষমতাচ্যুত ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে ওয়াহিদুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বার্তা দিলে তিনি লিখে জানান, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি
- আপলোড সময় : ৩১-০৫-২০২৫ ০৫:৫৫:৫৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩১-০৫-২০২৫ ০৫:৫৫:৫৫ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ